Opodebota
অপদেবতা
প্রথম ভাগ
হ্যালো, রহমান ভাই, আমি
পৌঁছেছি; আচ্ছা আমি জানাবো আপনাকে। আচ্ছা রাখি। -ফোনটা নামিয়ে রাখল সিফাত। সে
কিছুক্ষণ আগেই মিশরের এয়ারপোর্টে নেমেছে। বাংলাদেশি একটি বেসরকারি সংস্থাতে কাজ
করে সে। প্রোফাইল অ্যাসাইন্মেন্ট হিসেবে একজন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদের অধীনে কাজ
করতে এখানে এসেছে। কায়রো থেকে খানিকটা দূরে নতুন একটা পিরামিড আবিষ্কৃত হয়েছে। পিরামিডের
উপরেই রিসার্চ করতে হবে। সিফাত বিস্তারিতভাবে এখনও জানে না। সিফাতের জন্য হোটেলে
রুম বুক করা হয়েছে। তার সংস্থার মিশর শাখা থেকে গাড়ি পাঠানো হয়েছে। ওকে বলাই ছিল,
গাড়ি আসবে। আমি এখন পিরামিডের দেশে-গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল সিফাত। হঠাৎ কেমন যেন
একটা গন্ধ এসে লাগল নাকে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। আপনি কি অসুস্থ ? সামি জিজ্ঞেস করল। ওর একটা হাত ধরেছে।
সামি মিশর শাখার কর্মকর্তা। না মানে, কেমন যেন গন্ধ পেলাম! কোথায়? আমি তো পাচ্ছি
না,সামি বলল। এখন আর পাচ্ছি না, সিফাত বুঝতে পারছে না কী ঘটল। হোটেলে যাওয়ার পথে আর কোনো কথা বলল না কেউ।
সিফাতকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে সামি বলল, আপনি কদিন বিশ্রাম নিন। না, আমি ঠিক আছি,
একটু হাসার চেষ্টা করল সিফাত। ঠিক আছে। আমার ফোন নাম্বারটা রাখুন, দরকার হলে ফোন
দিবেন। গুড বাই, সামি বিন আব্দুল্লাহ। মিশরের ছেলে ও।
হোটেলে নাস্তা করার পরেই
যেন শক্তি ফিরে পেল। বসে থেকে কাজ নেই, ভাবল সিফাত। সামিকে ফোন দিল ওদের মিশর
শাখায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেখান থেকে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদের ঠিকানা নিয়ে, তার
সাথে দেখা করতে গেল। একটি দোতলা দালান। গেটের নামফলকে চোখ পড়ল- ডেভিড ল্যাংহাম,
ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ। তারপরে বাসার নাম্বার। বাড়ির কলিংবেল কোথায় গেল! সিফাত
কলিংবেল খুঁজছে। না পেয়ে শেষে কড়া নাড়ল। সাথে সাথেই বেরিয়ে এলো চুলপাকা, গোটা গোটা
দাড়িযুক্ত শেতাঙ্গ বুড়ো। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল যেন। তুমি সিফাত? হাত বাড়িয়ে
দিলেন তিনি। জ্বি সিফাত বুড়োর হাত ধরল। বুড়ো ওকে সাদরে ভিতরে নিয়ে গেলেন। বাড়ির
ভেতরে অগোছালো, এখানে ওখানে বই-এর ছড়াছড়ি। হঠাৎ এক ধরনের গন্ধ পেল সিফাত।
এয়ারপোর্টে তো এরকমই গন্ধ পেয়েছিল। ওর মনে হচ্ছে সবকিছু কাঁপছে। সবকিছু চক্রাকারে
ঘুরছে।
সিফাত তুমি কী অসুস্থ? ডেভিড
ল্যাংহাম ওর দিকে ঝুঁকে আছে। কেমন যেন একটা গন্ধ পেলাম। তারপর মাথা ঘুরছিল। এয়ারপোর্টেও হয়েছে এরকম একবার। সিফাত জানাল তাকে। ও এখন বুরোর রুমে শুয়ে আছে। এখানেও বইপত্র মাটিতে
গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিন্তু আমি তো গন্ধ পাইনি! চিন্তিত মনে হলো তাকে। ডেভিড পরক্ষণেই
হাসলেন। ওটা তোমার মনের ভুল হয়তো। বেশি কাজ করছ তো, সেজন্য বোধ হয় ক্লান্ত হয়ে
পড়েছ। হতে পারে। ইনকা সমাধি রিসার্চ শেষ করে সরাসরি এখানে। এখন একটু স্বস্তি বোধ
করছে সিফাত। দাঁড়াও কফি করে আনছি, খাও আর চাঙা হয়ে যাও। বুড়ো উঠে গেলেন। ফ্লাক্সে কফি রেখে দেন সবসময়। রাত জেগে পড়াশুনা করতে
হয়। পিরামিদ-মমি নিয়ে গবেষণা করে ৩০ বছর
কাটিয়ে ফেলেছেন। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল সিফাত। মাটি থেকে একটা বই তুলে নিল। বইটি
পিরামিডের অভিশাপ নিয়ে লেখা। পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে থমকে গেল সিফাত। অভিশাপের
গন্ধ! মানে কী? অনেক বিজ্ঞানী, প্রত্নতত্ত্ববিদ যারা পিরামিড, মমি নিয়ে গবেষণা করত এবং মমি উদ্ধারকাজে জড়িতরা অনেক
অদ্ভূত ধরনের গন্ধ পেতেন মাঝেমধ্যে যা অন্ন কেউ পেত না। ব্যাপারটি গোপন কড়া হয়েছে
যাতে পিরামিড নিয়ে গবেষণা বাধাগ্রস্থ না হয়। এবং এই গন্ধ পাওয়া ব্যক্তিরা সবাই
অদ্ভুতভাবে মারা গেছেন। এক বিজ্ঞানী.....এই নাও তোমার কফি কাপ্টা বাড়িয়ে দিলেন
ল্যাংহাম। ধন্যবাদ স্যার কাপটা নিতে নিতে বলল সিফাত। তোমার হাতের বইটা কিসের?
বৃদ্ধ ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। না,মানে সিফাত ব্যাপারটা বলবে কিনা বুঝতে
পারছে না। অভিশাপে বিশ্বাস কর? ল্যাংহাম কাপে চুমুক দিয়ে বলল। অবশ্যই না সিফাত জোর
দিয়ে বলার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। দেখো, এইসব বই পড়ে মাথায় ভূত ঢোকানোর দরকার
নেই। তুমি এখন নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে-তাহলে এই বই আমার এখানে কেন? সবকছু সম্পর্কে জানা
দরকার। কিন্তু তোমার এটা জানার দরকার নেই, বুড়ো ওর হাত থেকে বইটা কেড়ে নিল। এর
মানে উনি জানতেন আগে থেকেই। কিন্তু বুড়োর উত্তর মনমতো হলো না সিফাতের। কিছু একটা
আছে এর মধ্যে। কফি শেষ না করা পর্যন্ত আর কোনো কথা বলল না কেউ। বুড়োর রুমের ভিতরটা
চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে সিফাত। বড় দুইটা বইয়ের শেল্ফ। দেয়ালে ঘড়ি, কেলেন্দার, টেবিলের উপর আরও কিছু বই, যন্ত্রপাতি এবং একটা পিরামিডের মডেল। সুন্দরতো
পিরামিডটা বলতে বলতে কাছে এগিয়ে গেলো সিফাত। কিন্তু এটা নিয়েই ঝামেলা শুরু, ল্যাংহাম ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। আচ্ছা...এতদিন পরে
নতুন একটা পিরামিড আবিষ্কার হলো কীভাবে আর আপনি কী ঐ পিরামিডের সাথে এই মডেল
পিরামিডের কোনো মিল আছে? আন্দাজ করছে সিফাত। ঠিক বুড়ো একটা চেয়ারে বসেছেন। শোন
বলছি, কয়েকজন পর্যটক, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। একটা অতি প্রাচীন পিরামিড দেখতে
গিয়েছিলাম। আমি ওখানে অনেকবার গিয়েছি, তাই ওই এলাকায় কয়টা পিরামিড, কোথায় কি আছে
সবই আমার জানা। হঠাৎ একটা পিরামিড দেখলাম, মনে হল আগে কখনো দেখিনি। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে
দেখলাম। আসলে নতুন একটা পিরামিড আবিষ্কার করেছি আমরা। কিন্তু এতদিন চোখে পরেনি
কেন? আবার মাটি ফুঁড়ে উঠল কিনা- এইসব অদ্ভুত প্রশ্নও রয়েছে। ব্যাপারটা জানাজানি
হলে হুলুস্থুল কাণ্ড হয়ে যেত বিশ্বে। ভালো করে সব ঘেঁটে দেখার জন্য গোপন রাখা
হয়েছে। আমার মিশরের নাগরিকত্ব আছে। আর ইনকা সমাধির গোপন প্রজেক্টে তুমি দারুণ কাজ
করেছ বলে এখানে ডাকা হয়েছে।
কিন্তু মডেলের সাথে ঐ
পিরামিডের কি সম্পর্ক? সব ব্যাপার গোলমেলে লাগছে সিফাতের কাছে। এই মডেলটা
পিরামিডের কাছেই বালুর মধ্যে পেয়েছি”, বুড়ো হাতে নিলেন পিরামিডের মডেলটা। তাতে কী বোঝায়? এটা তো যে কেউ
ওখানে রাখতে পারে। পিরামিডের মডেল তো বাজারে কিনতে পাওয়া যায় . . . . সিফাত কথা
শেষ করতে পারল না ল্যাংহাম থামতে বলায়।এই মডেলটার সাথে আসল পিরামিডের সম্পূর্ণ মিল
রয়েছে। এটা মানুষের তৈরি করা সম্ভব নয়। কোনো প্রতিভাবান ব্যাক্তি...?উঁহু, অসম্ভব।
ল্যাংহাম পিরামিডের মডেলটা সিফাতের হাতে দিলেন। সিফাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে ওটা। সিফাত এক কাজ করো, জিনিসপত্র
নিয়ে আমার এখানে চলে আসো। দিন দুই পরে কাগজপত্র অনুমোদন করিয়ে পিরামিডের ওখানে
ক্যাম্প করতে হবে, ল্যাংহাম উঠে দাঁড়িয়েছেন। বিদায় দিয়ে হোটেলে ফিরে আসল সিফাত।
অনেকদিন পর রাতে সুন্দর একটা ঘুম হল সিফাতের।
সকালে হোটেলে নাস্তা
সেরে জিনিসপত্র নিয়ে ডেভিড ল্যাংহামের বাড়িতে চলে আসল সিফাত। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম,
ইয়াংম্যান। ল্যাংহাম সিফাতকে তার রুম দেখিয়ে দিলেন। জিনিসপত্র রেখে চলে আসো, কফি
খাই দুইজনে। এরপর সারাদিন পিরামিড নিয়ে কোনো কথাই হলো না। একবার জিজ্ঞেস করতেই
ল্যাংহাম বললেন, সবকিছু মোটামুটি রেডি, পরশু ক্যাম্প করছি। রাতে আকাশ দেখবেন বলে
সিফাতকে ছাদে নিয়ে এলেন। ওনার একটা টেলিস্কোপ আছে। আকাশ একদম পরিষ্কার। ল্যাংহাম
নক্ষত্র চেনাচ্ছেন সিফাতকে। সিফাত দেখছে আর ভাবছে এতো নাম মনে রাখা সম্ভব। আজকের
মতো নক্ষত্র দেখা পর্ব শেষ” ঘোষণার সূরে বললেন ল্যাংহাম। আজকে চাঁদটা দেখো।
পূর্ণিমা আজকে। মরুভূমির দেশে পূর্ণিমা অন্যরকম ভালো লাগছে, মনে মনে বলল সিফাত।
পাশের খেজুর গাছের মাথায় চাঁদটা একদম রুপোর থালা। কিন্তু ওর পাশের চাঁদটা আরও
উজ্জ্বল লাগল... চিৎকার করে উঠলো সিফাত; ‘স্যার, আকাশে দুইটা চাঁদ !!!’’ ‘হোয়াট? ও
মাই গড’’ ... !!
দ্বিতীয় ভাগ
ও মাই গড......!! আবার রিপিট করল। ডেভিড ল্যাংহাম আঙ্গুল তুলে ধরেছেন সামনে। “সিফাত, দৌড় দিয়ে আমার রুমে
যাও।থাক।তুমি দাঁড়াও,আমি যাচ্ছি, ক্যামেরা নিয়ে আসছি।” ল্যাংহামের
কথায় খেয়াল নেই সিফাতের। ও চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। আসলেই কি দুইটা চাঁদ? অসম্ভব !
এটা কি দৃষ্টিভ্রম ? তাহলে স্যার ল্যাংহাম ও তো দেখেছেন। “স্যার ল্যাংহাম কোথায় গেলেন?” সিফাত আশেপাশে
তাকাল।টেলিস্কোপ তো জায়গামত আছে। “স্যার ল্যাংহাম!” নিচে
নামার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ডাকল সিফাত। কোনো সাড়াশব্দ নেই। “ব্যাপার কি?” সিড়ি দিয়ে
নামতে শুরু করল সিফাত। সিড়ির এক একেকটা ধাপ পার হচ্ছে আর মনে হচ্ছে একটা গন্ধ
তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ওর পা ভারী হয়ে যাচ্ছে। সিড়ি পুরো অন্ধকার হয়ে গেছে।
“টেলিস্কোপ তো আনিনি। দরজাও তো বন্ধ করিনি। তাহলে চাঁদের আলো কোথায় গেল? আবার ছাদে
গিয়ে টেলিস্কোপ নিয়ে আসবো!” কিন্তু ছাদে উঠতে ওর মন চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অন্য
কোথাও চলে এসেছে। দেয়াল ধরে নামতে শুরু করল ধীরে ধীরে। হঠাৎ পা ফসকে পরে গেল
সিফাত। “উফ!” সব লাইট নিভিয়ে
দিয়েছেন কেন ল্যাংহাম? ”স্যার ল্যাংহাম!” প্রতিধ্বনি হলো ওর কথায়। “মানে!” কোথায়
এসে পরেছে ও? গোঙানির শব্দ শুনল সিফাত। আবার স্বাভাবিক শক্তি ফিরে পেল সিফাত।
“গোঙাচ্ছে কে? মি.ল্যাংহাম!” ”ডেভিড ল্যাংহাম!” চিৎকার করল সিফাত। “মোবাইলটা কই?” পকেট হাতড়াচ্ছে ও। “ধুত্তরি! রুমে ফেলে
এসেছি।” সিড়ি মনে হয় শেষ। সমান জায়গা দিয়ে হাঁটছে। ব্যথায় ডান-পা টা টনটন করছে। হঠাৎ অনেক কথাবার্তা শুনতে পেল। আগুন
জ্বলছে বোধহয়। “কারা
ওখানে ?” ভাবল সিফাত। ল্যাংহামের বাড়িতে ভূতের আসর বসেছে নাকি ! আনমনে হাসল সিফাত।
দেয়াল ধরে হাঁটছে আলোর দিকে লক্ষ্য রেখে। হঠাৎ পাশের দেয়ালে চোখ পড়ল। সামান্য
আলোতে দেখল দণ্ড হাতে মৃত আত্মার প্রতীক মনে করা হয় যাকে, তার ছবি। আর অদ্ভুত সব
ছবি। কিছুই বুঝলো না সিফাত। “ল্যাংহামের বাড়িতে এসব কোথা থেকে এল!” “ল্যাংহাম...” চেঁচালো সিফাত। “সিফাতের গলা!” কে যেন বলে
উঠল। আলোটা সিফাতের দিকে আসছে। মশাল হাতে সামি বিন আব্দুল্লাহ। সাথে আর কিছু
মিসরীয়। “একি, তোমরা এখানে?” সিফাত কিছুটা
অবাক। “এখানে মানে! আমরা নতুন পিরামিডের মধ্যে।” সামি অবাক। “মজা করছ কেন?” সিফাত
হাসল। “মজা করব কেন! আমরা সবাই একসাথে ভিতরে ঢুকলাম। তারপরে ল্যাংহাম আর আপনি
কোথায় হারিয়ে গেলেন ? প্রথমে ল্যাংহাম স্যার, পরে আপনাকে পেলাম। দুজনই একইরকম কথা
বলছেন। আপনারা কি বলতে চাচ্ছেন? কোনোরকম ভয় পেয়ে
পিছিয়ে যাচ্ছেন নাকি?” সামি কিছুটা বিরক্ত মনে হয়। “কালকে তো এখানে আসার কথা ছিল।
ডেভিড ল্যাংহামের বাড়ির ছাদ থেকে এখানে কিভাবে আসবো?” সিফাত প্রশ্ন ছুড়ে দিল।“আবোল
তাবোল কি বলছেন?গতকাল এখানে এসেছি। পিরামিডে ঢুকেই তো লাপাত্তা হলেন। কিছু মনে নেই?
কি হল আপনাদের? ক্যাম্পে চলুন। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।””কি হচ্ছে উল্টাপাল্টা ! পাগল
হয়ে যাব!” যেতে যেতে বলল সিফাত।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সিফাত।
পরিষ্কার আকাশে চাঁদটা রূপের হাসি হাসছে। এতক্ষন কি ঘটল ওর জীবনে? সব গোলমেলে লাগছে।“আর
ভাবতে চাই না।” উঠে গিয়ে তাবুতে ঢুকল
সিফাত। মরুভূমির রাতের ঠাণ্ডা অন্নরকম কাঁপুনি দিচ্ছে ওর গায়ে। মাথাটা খুব ধরেছে।
ঘুমোতে হবে ওকে। ধীরে ধীরে চোখের পাতা বন্ধ করল। অনেক ঘুম পাচ্ছে ওর। সারাজিবন
ঘুমাতে পারলেই ভাল হতো ।
“সিফাত, সিফাত! সারাদিন ঘুমোবে
নাকি? সিফাত...” ধীরে ধীরে চোখ খুলল ও। খাটে শুয়ে আছে ও। পাশে ডেভিড ল্যাংহাম
একগাদা কাগজপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। উঠে বসার চেষ্টা করল সিফাত। আহ ! পায়ের ব্যথা
জানিয়ে দিল তার অস্তিত্ব। “স্যার, কাল রাতে আপনাকে দেখলাম না।” সিফাত জিজ্ঞেস করল
“দেখলে না মানে ! ছাদ থেকে আকাশে দুটো চাঁদ দেখার পর আমি ক্যামেরা আনতে নিছে
গিয়েছিলাম। পরে একটা শব্দ শুনে এসে দেখলাম তুমি বিছানায় ঘুমাচ্ছ।” স্থির দৃষ্টিতে
তাকিয়ে আছেন ল্যাংহাম সিফাতের দিকে। “মানে !” আশেপাশে তাকালো সিফাত। বইয়ের শেলফ, ওর ব্যাগটা পড়ে
আছে চেয়ারের ওপর। “আমি তো আপনার বাড়িতেই আছি, তাই না?” সিফাত প্রশ্ন করল ।
“অবশ্যই... কোন সন্দেহ !” অবাক হচ্ছেন ল্যাংহাম। “তাহলে কাল রাতে সামি বলল
পিরামিডের ভিতর...।” “কাল নয় আজ যাব।” সিফাতের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিলেন ল্যাংহাম।
“সামি আসলো কোথা থেকে ?” “কালকে পিরামিডের
ভিতর...” সিফাতের সব কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। খট খট খট খট ! “দরজায় কেউ এসেছে”
ল্যাংহাম যাওয়ার আগে বললেন “তুমি স্বপ্নটপ্ন দেখেছ বোধহয়।” “কিন্তু কাল রাত থেকে
মাথাটা খুব ধরেছে। “সিফাত মাথায় হাত দিয়ে
চেপে ধরে বলল। সামি বিন আব্দুল্লাহ এসেছে ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। “দ্রুত নাস্তা শেষ কর সবাই” বললেন দলনেতা মি. ডেভিড
ল্যাংহাম। নাস্তা সেরে সবাই গাড়িতে চেপে বসল। গন্তব্যে পৌছাতে ঘণ্টা তিনেক সময়
লাগবে। রাস্তার দুপাশে বালুর সমুদ্র। তাতে নানা জাতের নিঃসঙ্গ ক্যাকটাস ভেসে
রয়েছে। “মিসরে এসে দিন দিন
মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।” মনে মনে বলল সিফাত। “নতুন
পিরামিড, হুবহু মডেলের দুইটা
চাঁদ, সিড়ি থেকে পরে যাওয়া, পিরামিডের ভিতর স্বপ্ন, সামি...দূর! সব এলোমেলো লাগছে।”
যোগ সুত্র না মেলাতে পেরে ধূসর বালুতে দৃষ্টি
নিবদ্ধ করল সিফাত। কিন্তু ব্যাপারগুল ওকে খুব ভাবাচ্ছিল। স্বপ্ন যদি দেখে থাকে
তাহলে গোঙানির শব্দ? সেটাতো ও স্স্পষ্ট শুনেছে। স্বপ্ন ও বাস্তব একসাথে কিভাবে
চলতে পারে ?
একটা গন্ধ পেয়েই নাক কুঁচকে ফেলল সামি বিন আব্দুল্লাহ। সিফাত ও গন্ধ টা
পাচ্ছে, ডেভিড ল্যাংহাম নাক চেপে ধরেছেন। গাড়ি থামাতে বললেন ল্যাংহাম। “সবাই গাড়ি
থেকে নামো।” গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো সবাই। সিফাতের বুঝতে অসুবিধা হল না। এটা সেই
গন্ধ যেটা এয়ারপোর্ট থেকে ওর পিছু নিয়েছে। কিন্তু এবার শুধু ওই নয় গাড়ির সবাই
গন্ধটা পেয়েছে। অভিশাপের গন্ধ কিসের ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে কে জানে ! হয়ত গাড়ি
দুর্ঘটনা ঘটতে পারত ! কিন্তু এই নির্জন মরুভূমিতে কী ঘটত? সিফাতের দিকে এগিয়ে এলেন
ল্যাংহাম। “সিফাত,আমি জানি তুমি কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছ। আমরা অকল্পনীয় কিছু
আবিষ্কার করতে যাচ্ছি যদি না আমার ধারণা ভুল হয়।” মুচকি হেসে আবার সবাইকে গাড়িতে
উঠতে বললেন ল্যাংহাম। গন্ধটা আর নেই। বালুর সাগর দুইপাশে রেখে ছুটে চলছে তাদের
গাড়িটা। চারজন আরোহী উত্তেজনায় ছটফট করছে- কখন পৌঁছাবে।
“পিরামিডটা ঐ পিরামিডের পিছে।” আঙ্গুল তুলে দেখালেন ডেভিড।“আর ক্যাম্প করা
হয়েছে ডান পাশে।” সামি দেখিয়ে দিল। সবাই হেঁটে ক্যাম্পের কাছে আসল। জোব্বা
পরা,সাদা দাঁড়ি রোদে চকচক করছে। ল্যাংহাম এগিয়ে গিয়ে হাত মেলালেন তার সাথে। “ইনি
হচ্ছেন আবু বকর সিদ্দিকী ইবনে মোহাম্মাদ। হায়রোগ্লিফিক বিশেষজ্ঞ।” সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ল্যাংহাম। “আমি সিফাত।” এগিয়ে
গিয়ে হাত মেলালো ও।“পরিচিত হয়ে আনন্দিত হলাম।” হেসে বলল সিদ্দিকী। “সবাই পিরামিডটা
দেখে আসি।” সামি বলল। সোনালি বালু ঝিকঝিক করছে। পিরামিডটা পুরনো বটে। সিফাত হাত
রাখল পিরামিডের উপর। “উফ !
গরম !” তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিল সিফাত। “সিফাত এদিকে এসো।” সবাই পিরামিডের আরেকপাশে
চলে এসেছে। সিফাত দ্রুত পায়ে চলে আসল।“দেখো এখান আমি মডেলটা পেয়েছিলাম। ” গর্ত মতো
একটা জায়াগা দেখালো ডেভিড। গর্ত টা যেন পিরামিড রাখার জন্যই বানানো হয়েছে। সিফাত
নিচু হয়ে দেখছে। এই প্রথম এরকম কোনো ঘটনা ঘটলো। “কালকে আমরা ভিতরে ঢুকবো।“ ল্যাংহাম সবাইকে
জানিয়ে দিলেন।“প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এসে গেছে?” আসছে।” সামি
উত্তর দিলেন।
রাতের খাওয়া শেষে তাঁবুর বাইরে পায়চারি করছে সিফাত। কয়দিনে ঘটে যাওয়া
ঘটনাগুলো মেলাতে চেষ্টা করছে ও। গন্ধটা যদি অভিশাপ হয় তবে তা সাবধান হতে বলছে ওকে।
তাহলে অপদেবতার ঘটনাগুলো কি আসলেই
সত্যি? অপদেবতা বাস্তব হলে একেবারে মেরে ফেলতে পারে না? গন্ধ ছড়ানোর মানে কি ?
ভাবছে আর পিরামিডের দিকে তাকিয়ে আছে সিফাত। চাঁদের আলোতে অন্য রূপ নিয়েছে মরুভূমি।
ওর চেনা চেনা লাগছে পরিবেশটা। “আগেও এখানে এসেছি!”
অস্ফুট স্বরে বলল ও। একটা দীর্ঘশ্বাস পিরামিডের গায়ে। সিফাত ভেবেছিল তার নিজের
ছায়া। কিন্তু হঠাত ছায়াটি নরে উঠল। ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। (চলবে)
Comments
Post a Comment