একটি নীলাভ বিন্দু - যেখানে রয়েছে প্রাণের স্পন্দন।
ছবিটি ভালো করে একবার দেখুন। কি দেখতে পাচ্ছেন। একটা ঝাপসা ছবি। এখনকার মতো হাইপিক্সেল এ তোলা নয়।কিন্তু ছবিটির মাঝে লুকিয়ে অাছে অসাধারন এক জিনিস। ওই যে এক কোনায়। ছোটো একটা নীলাভ বিন্দু দেখতে পাচ্ছেন। মনে হতে পারে রাতের অাকাশে তোলা কোনো এক নক্ষত্রের ছবি। কিন্তু না। এটা আমাদের বাসস্থান। আমাদের পৃথিবী। এখানে রয়েছে প্রাণের স্পন্দন। যেটা কিনা বিশাল মহাশুন্যে একটি পিক্সেলের থেকেও ছোটো। মাত্র ০.১২ পিক্সেল।
১৯৭৭ সালে নাসা তাদের ৭২২ কেজির স্পেসক্রাফট ভয়েজার ১ কে মহাকাশে প্রেরন করে। মূলত সৌরজগতের প্রধান বড় দুই গ্রহ ও তাদের উপগ্রহ এবং একই সাথে আমাদের সৌরজগতের বাইরের অংশ সম্পর্কে জানার জন্য এটি প্রেরন করা হয়। যাত্রাপথে ভয়েজার ১ বৃহস্পতি ও শনির পাশ দিয়ে যায় এবং বিস্ময়কর কিছু ছবি তোলে। যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
ছবিঃ ভয়েজার ১ এ তোলা বৃহস্পতির ছবি
ভয়েজার ১ যখন তার প্রাইমারী মিশন শেষ করে সৌরজগত ত্যাগ করবে; তখন বিখ্যাত বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগান প্রবের ক্যামেরা পৃথিবীর দিকে ঘুরিয়ে একটি শেষ ছবি তোলার অনুরোধ করেন। শোনা যায় তার সহকর্মীদের এটা নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিলো না। তাদের মতে ছবিটি হয়তো মহাকাশ গবেষনায় কোনো কাজে লাগবে না।
**************কার্ল স্যাগান*************
তবে কার্ল স্যাগানের অনুরোধ নাসা রাখলো। ১৯৯০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী 4:48GMT পৃথিবী থেকে ৬ বিলিয়ন কিমি দূর থেকে তোলা হল সেই বিখ্যাত ছবি। আমাদের পৃথিবীর ছবি।একটি নীল বিন্দু, ছোটো একটি পিক্সেলের থেকেও। ৬০ টি ফ্রেমে তোলা হয়েছিলো ছবিটি।তার মধ্যে তিনটি ফ্রেমকে কালার ফিল্টার করে পাওয়া যায় ছবিটি। এই ছবিটি কার্ল স্যাগানকে এতোটাই অভিভূত করে যে ১৯৯৪ সালে পেল ব্লু ডট: এ ভিশন অফ দ্য হিউম্যান ফিউচার ইন স্পেস (Pale Blue Dot: A Vision of the Human Future in Space) বইটি লেখেন। বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগান তার বইতে ছবিটির সুন্দর একটা ধারনা দেন----
“এই যে বিন্দুটা আবার দেখুন। এখানেই। এটাই বাড়ি। এটির উপরে আপনি, যারা যারা আপনার প্রিয়, যাদের সম্পর্কে জানেন, আপনি যার সম্পর্কে শুনেছেন, প্রতিটি মানুষ যারা কখনও ছিলেন, যারা জীবনযাপন করেছিলেন। আমাদের আনন্দ ও দুর্ভোগের সমষ্টি, সহস্র আত্মবিশ্বাসী ধর্ম, আদর্শ, এবং অর্থনৈতিক মতবাদ, প্রতিটি শিকারী এবং পালক, প্রত্যেক বীর এবং কাপুরুষ, সভ্যতার প্রতিটি স্রষ্টা এবং ধ্বংসকারী, প্রতিটি রাজা এবং কৃষক, প্রেমে মগ্ন প্রতিটি যুবক এবং প্রতিটি মা পিতা, আশাবাদী শিশু, উদ্ভাবক এবং অন্বেষণকারী, নৈতিকতার প্রতিটি শিক্ষক, প্রতিটি দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, প্রত্যেক "সুপারস্টার," প্রত্যেক "সর্বোচ্চ নেতা," আমাদের প্রজাতির ইতিহাসে প্রত্যেক সাধু ও পাপী সেখানে বাস করতেন ধুলির এক টুকরোতে বিস্তৃত মহাজাগতিক অঙ্গনে।
পৃথিবী একটি খুব ছোট পর্যায়। এই পিক্সেলের এক কোণে বাসিন্দাদের দ্বারা অন্য কোনও কোণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পৃথকযোগ্য লোকদের দ্বারা পরিদর্শন করা অবিরাম নিষ্ঠুরতার কথা চিন্তা করুন, তাদের ভুল বোঝাবুঝি, তারা একে অপরকে হত্যা করার জন্য কতটা আগ্রহী, তাদের ঘৃণা কতটা উৎসাহী। সেই সমস্ত সেনাপতি এবং সম্রাটদের দ্বারা প্রবাহিত রক্তের নদীগুলির কথা চিন্তা করুন। যাতে গৌরব ও বিজয় লাভের ফলে তারা কোনও বিন্দুর একটি ভগ্নাংশের ক্ষণিকের অধিপতি হয়ে উঠতে পারে।
বলা হয়ে থাকে যে জ্যোতির্বিজ্ঞান হল একটি নম্র ও চরিত্র গঠনের অভিজ্ঞতা- আমাদের ক্ষুদ্র জগতের এই দূরবর্তী চিত্র আমাদের মানবিক বোকামির সম্ভবত সবচেয়ে ভালো উদাহরন দেয়। আমার কাছে এটি একে অপরের সাথে আরও সদ্ব্যবহার করাকে গুরুত্ব দেয় এবং একইসাথে আমাদের উপদেশ দেয় ফ্যাকাশে নীল বিন্দুর সংরক্ষণ এবং লালন করা যাকে আমরা এখনও আমাদের বাসস্থান হিসেবে জানি ।”
৬৩৭১ কিমি ব্যাসার্ধের পৃথিবী যদি এই অসীম মহাবিশ্বে একটা বিন্দু হয় তাহলে আমরা সাড়ে তিন হাত মানুষের অস্তিত্ব কোথায় একবার ভেবে দেখুন।
Comments
Post a Comment